সংশ্লিষ্ট নির্বাচন অফিসে পুনঃভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ আবেদন করলেও এখন পর্যন্ত কোনো কাজ হয়নি। এ ঘটনায় ভুক্তভোগীদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। তদন্ত সাপেক্ষে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থাসহ দ্রুত পুনঃভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তের দাবি জানিয়েছেন তারা।
জেলার বোদা উপজেলার ঝলইশালশিরী ইউনিয়নের ধরধরা প্রধানপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জীতেন্দ্র নাথ বর্মন ২০০৮ সালে ভোটার তালিকায় নাম উত্তোলন করেন। পাঁচ বছর আগে ২০১৬ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আপন ছোট ভাই অজিতকে ভোট দিতে পারেননি তিনি। জীবিত থেকে শিক্ষার্থীদের পাঠদানসহ স্বাভাবিক সকল কার্যক্রম চালিয়ে আসলেও নির্বাচন কমিশনের সার্ভার থেকে তার নাম কর্তন করা হয়েছে। সার্ভারে কোনো তথ্য নেই, তাকে মৃত দেখানো হয়েছে।
বোদা উপজেলা নির্বাচন অফিস ২০১২ সালের ভোটার তালিকা হালনাগাদে জীতেন্দ্রনাথকে মৃত দেখিয়ে ভোটার তালিকা থেকে নাম কর্তন করেছেন। নির্বাচন কমিশনের সার্ভারে নাম না থাকায় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের আওতাধীন ইএফটিতেও (ইলেকট্রিক ফান্ড ট্রান্সফার-বৈদ্যুতিক তহবিল স্থানান্তর) নাম নিবন্ধন করতে পারেননি। এর ফলে বেতনভাতা হচ্ছে না, ফিক্সেশনও হচ্ছে না। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে ইএফটি করতে গিয়ে অনলাইনে তার আবেদন এক্সেপ্ট হচ্ছে না। খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন নির্বাচন অফিসের ভোটার তালিকায় তার নাম নেই। তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন।
অন্যদিকে জেলার বোদা উপজেলার বোদা পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ডের নগরকুমারী এলাকার বাসিন্দা মনোয়ার হোসেন মনু ২০০৮ সালে ভোটার হন। ২০১৭ সালে বোদা পৌরসভা নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি। ভোটার তালিকায় নাম ছিল না। বোদা উপজেলা নির্বাচন অফিসে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন নির্বাচন কমিশনের সার্ভারে তার নাম নেই। তাকে কর্তন করা হয়েছে। বোদা উপজেলা নির্বাচন অফিস ২০১৪ সালের ভোটার তালিকা হালনাগাদে তাকে মৃত দেখিয়েছেন এবং ভোটার তালিকা থেকে নাম কর্তন করেছেন। নির্বাচন কমিশনের সার্ভারে নাম না থাকায় ব্যাংকে ঋণ করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন, কোভিডের টিকার রেজিস্ট্রেশনও করতে পারেননি।
আরও পড়ুন: এনআইডি জালিয়াতি: উপসচিবসহ ৫ নির্বাচনী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা
১৪ বছরের বেশি বয়সীদের স্মার্ট এনআইডি দিতে একনেকে প্রকল্প অনুমোদন
পঞ্চগড় জেলার পাঁচ উপজেলায় জীবিত যেসব মানুষকে মৃত বানানো হয়েছে তারা হলেন-জেলার বোদা উপজেলার বোদা পৌরসভার নগরকুমারী গ্রামের বাসিন্দা ভারতী, বোদা উপজেলার বড়শশী ইউনিয়নের ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের মো. অছিরউদ্দিন, একই উপজেলার বেংহারী বনগ্রাম ইউনিয়নের কামারপাড়া গ্রামের সনেবালা, ঝলইশালশিরী ইউনিয়নের মাঝাপাড় গ্রামের মোছা. নারগিছ, ঝলইশালশিরী ইউনিয়নের কালিয়াগঞ্জ গ্রামের জিরন বালা, ঝলইশালশিরী ইউনিয়নের লাঙ্গলগাঁও গ্রামের কাহাবানী, চন্দনবাড়ি ইউনিয়নের কুমারপাড়া গ্রামের মোহাম্মদ আলী, একই গ্রামের মো. আজিমউদ্দিন, একই গ্রামের মো. মকবুল হোসেন প্রমুখ।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের (মিস-ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম) মাধ্যমে সুবিধাভোগীদের ভাতা প্রদানের কার্যক্রম হাতে নেয়ায় অনলাইন ডাটাবেজ তৈরিতে অনেকের ডাটা অসম্পূর্ণ দেখাচ্ছে। এসব সুবিধাভোগীরা নির্বাচন অফিসে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন ভোটার তালিকায় তাদের নাম কর্তন করা হয়েছে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের চলমান এ কার্যক্রম সম্পন্ন হলে জীবিতকে মৃত বানানোর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
পঞ্চগড় সদর, বোদা তেঁতুলিয়া ও আটোয়ারী উপজেলা নির্বাচন অফিস ২০১০ সাল থেকে ২০১৭ সালের ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রমের সময় এসব জীবিত মানুষকে মৃত দেখিয়ে ভোটার তালিকা থেকে নাম কর্তন করেছেন।
প্রধান শিক্ষক জীতেন্দ্র নাথ বর্মন জানান, বোদা উপজেলা নির্বাচন অফিস ২০১৪ সালে তাকে মৃত ঘোষণা করে। তবে কোন শিক্ষক (তথ্য সংগ্রহকারী ও সুপারভাইজার) তার তথ্য সংগ্রহ করেছেন এবং মৃত হিসেবে ভোটার তালিকা থেকে কর্তনের জন্য কে বা কারা আবেদন করেছেন তা তাকে জানাতে পারেননি। উপজেলা নির্বাচন অফিসের কাছে এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য বা কাগজপত্র নেই বলে তাকে জানানো হয়। জীবিত মানুষটিকে কারা কীভাবে মৃত বানাল এর দায়ভার কার প্রশ্ন তার।
ভুক্তভোগী মনোয়ার হোসেন মনু বলেন, ‘আমি জীবিত আছি। স্বাভাবিকভাবে চলাচল করছি। ব্যবসা-বাণিজ্য করে আসছি। আমাকে কেন মৃত হিসেবে ভোটার তালিকা থেকে নাম কর্তন করা হলো তার বিচার চাই। কে আমাকে মেরেছে এ বিষয়ে তদন্ত করা হোক।’
তিনি বলেন, নির্বাচন অফিসারসহ সংশ্লিষ্টদের কথার মূল্য নেই। আমাকে একাধিকবার হয়রানি করেছে। ভোটার তালিকায় পুনরায় নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি বোদা উপজেলা নির্বাচন অফিসে আবেদন করেছি। আড়াই মাস পরও ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত হয়নি। কারা কীভাবে এ ঘটনাটি ঘটিয়েছে তার কোনো কাগজপত্রও দেখাতে পারেননি। এ বিষয়ে সুষ্ঠু কোনো সমাধানের কথাও জানাতে পারেননি। বারবার যোগাযোগ করে এখন পর্যন্ত কাজ না হওয়ায় আমি হতাশ হয়ে পড়েছি।
জেলার বোদা উপজেলার চন্দনবাড়ী ইউনিয়নের কুমারপাড়া এলাকার ভুক্তভোগী মোহাম্মদ আলীর ছেলে আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘তথ্য সংগ্রহকারী ও সুপারভাইজাররা যাচাই-বাছাই না করে লোকমুখের কথা শুনে জীবিত ব্যক্তিদের মৃত হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এটা কি মগের মুল্লুক নাকি। তাদের ভুলের কারণে আমার বৃদ্ধ বাবার ভাতা আটকে গেছে। শুধু আমার বাবা নয় নির্বাচন অফিস আমাদের এলাকার আরও ৩-৪ জন জীবিত মানুষকে মৃত বানিয়েছে। এ ঘটনাগুলোর সাথে কারা কারা জড়িত এজন্য তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।’
বোদা পৌরসভার প্যানেল মেয়র মো. খাদেমুল ইসলাম জানান, মনোয়ার হোসেন মনুকে পুনরায় ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে প্রত্যয়নপত্র দেয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন: প্রবাসী বাংলাদেশিদের এনআইডি দেয়ার পরিকল্পনা ঢাকার
এনআইডি জালিয়াতি করে জমি বিক্রি চক্রের ৪ সদস্য আটক
বোদা উপজেলার ঝলই শালশিরী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল হোসেন বলেন, ‘আমার এলাকার প্রায় ১০-১২ জন জীবিত লোককে মৃত বানানো হয়েছে। আমি ইতোমধ্যে ৫-৭ জনকে পুনঃভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য উপজেলা নির্বাচন অফিসে প্রত্যয়নপত্র দিয়ে আবেদন করিয়েছি।’
বোদা উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. শহিদুল ইসলাম সরকার বলেন, ‘আমি কিছুদিন হলো এখানে যোগদান করেছি। আমি অনেক বিষয় বলতে পারব না। এগুলো কীভাবে হয়েছে তা আমার জানা নেই। পূর্বের কোনো ডকুমেন্টও অফিসে নেই। তবে ভোটার তালিকায় পুনরায় নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য বেশ কিছু আবেদন দেয়া হয়েছে। আরও কয়েকটি আসতে পারে। যেসব আবেদন পেয়েছি সেগুলো আমি জেলা নির্বাচন অফিসে পাঠিয়ে দিয়েছি। জেলা কর্মকর্তার সুপারিশের পর এসব আবেদন নির্বাচন কমিশনে পাঠানো হবে।’
জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. আলমগীর বলেন, ‘মৃত্যুজনিত কারণ ছাড়া অন্য কোনো কারণে কারও নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ যায় না। হালনাগাদ করার সময় কোনো ডিজিট ভুলের কারণে বা তথ্য সংগ্রহকারী ও সুপারভাইজাররা ভুলবশত এমনটি করতে পারে। আমি বোদা উপজেলা থেকে এমন ২০টি আবেদন পেয়েছি যেগুলো নির্বাচন কমিশনে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। কে কীভাবে এটি করল বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’